মাথা ব্যথার কারণ
মাথাব্যথাকে তিনটি প্রধান গ্রুপে ভাগ করা হয়ে থাকে:
- প্রাথমিক মাথাব্যথা
- সেকেন্ডারি মাথাব্যথা
- নিউরোপ্যাথি, মুখমণ্ডলীয় ব্যথা এবং অন্যান্য মাথাব্যথা
প্রাথমিক মাথাব্যথা
* মাইগ্রেন
* টেনশন-টাইপ মাথাব্যথা
*ট্রাইজেমিনাল অটোনোমিক সেফালএলজিয়া’জ
* অন্যান্য প্রাথমিক মাথাব্যথাজনিত ডিজঅর্ডার – ইন্টারন্যাশনাল ক্লাসিফিকেশন অব হেডএক ডিজঅর্ডারের তৃতীয় ইডিশন অনুযায়ী, অন্যান্য প্রাথমিক মাথাব্যথাজনিত ডিজঅর্ডারের মধ্যে আছে-
- প্রাথমিক কাশিজনিত মাথাব্যথা
- সম্ভাব্য প্রাথমিক কাশিজনিত মাথাব্যাথা
- ব্যায়ামের কারণে প্রাথমিক মাথাব্যথা
- সম্ভাব্য ব্যায়ামের কারণে প্রাথমিক মাথাব্যথা
- যৌনক্রিয়ার সাথে জড়িত প্রাথমিক মাথাব্যথা
- সম্ভাব্য যৌনক্রিয়ার সাথে জড়িত প্রাথমিক মাথাব্যথা
- প্রাথমিক থান্ডারক্ল্যাপ মাথাব্যথা
- ঠান্ডা উদ্দীপক মাথাব্যথা
- ঠান্ডা উদ্দীপক বা স্টিমুলাসের বহিরাগত প্রয়োগের জন্য দায়ী মাথাব্যথা
- ঠান্ডা উদ্দীপনা গ্রহণ বা শ্বাস নেওয়ার জন্য দায়ী মাথাব্যথা
- সম্ভাব্য ঠান্ডা উদ্দীপক মাথাব্যথা
- বাহ্যিক চাপের কারণে মাথাব্যথা
- বাহ্যিক কমপ্রেশন বা সংকোচন এর কারণে মাথাব্যথা
- বাহ্যিক ট্রাকশনের এর কারণে মাথাব্যথা
- সম্ভাব্য বাহ্যিক চাপের কারণে মাথাব্যথা
- সম্ভাব্য বাহ্যিক কমপ্রেশন জনিত মাথাব্যথা
- সম্ভাব্য বাহ্যিক ট্রাকশন জনিত মাথাব্যথা
- প্রাথমিক স্ট্যাবিং মাথাব্যথা
- সম্ভাব্য প্রাথমিক স্ট্যাবিং মাথাব্যথা
- নমমিউলার মাথাব্যথা
- সম্ভাব্য নমমিউলার মাথাব্যথা
- হিপনিক মাথাব্যথা
- সম্ভাব্য হিপনিক মাথাব্যথা
- প্রাত্যহিক ক্রমাগত মাথাব্যথা( এনডিপিএইচ)
- সম্ভাব্য প্রাত্যদিক ক্রমাগত মাথাব্যথা
সেকেন্ডারি মাথাব্যথা
- মাথা বা ঘাড়ে আঘাত পেলে তার কারণে মাথাব্যথা
- ক্রেনিয়াল অথবা সারভাইক্যাল ভাসকুলার ডিজঅর্ডার জনিত মাথাব্যথা
- নন ভাস্কুলার ইন্ট্রাক্রেনিয়াল ডিজঅর্ডার এর সাথে জড়িত মাথাব্যথা
- নেশাজাতীয় বস্তু গ্রহণের কারণে মাথাব্যথা
- সংক্রমণে মাথাব্যথা
- হোমিওস্ট্যাটিসের ডিজঅর্ডারের কারণে মাথাব্যথা
- ক্রেনিয়াম, ঘাড়, চোখ, কান, নাক, সাইনাস, দাঁত, মুখ বা অন্য কোন ফেশিয়াল অথবা ক্রেনিয়াল স্ট্রাকচার এর ডিজঅর্ডারের সাথে জড়িত মাথাব্যথা
- সাইকিয়াট্রিক ডিজঅর্ডার বা মানসিক সমস্যার কারণে মাথাব্যথা
প্রাথমিক মাথাব্যথার কারণ :
এই ধরণের মাথাব্যথা কোন গাঠনিক বা শারীরবৃত্তীয় অস্বাভাবিকতার কারণে হয়না। সংক্রমণ বা প্রদাহের সাথেও এদের সম্পর্ক নেই।
মাইগ্রেন
২০১৬ সালের গ্লোবান বার্ডেন অব ডিজিজ স্টাডি অনুযায়ী, ৩২৮ টি রোগ এবং ইঞ্জুরির মূল্যায়নে মাইগ্রেন ৬ষ্ঠ অবস্থানে ছিল। এটি এক ধরণের পুনরাবৃত্তিক মাথাব্যথা রোগ।
- সচরাচর ২২-৫৫ বছর বয়সী গ্রুপের এই ধরণের মাথাব্যথা বেশি হয়।
- ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা বেশি আক্রান্ত হয়।
- পারিবারিক ইতিহাস থাকলেও হতে পারে।
মাইগ্রেন কেন হয়, তার সুনির্দিষ্ট কোন কারণ খুঁজে পাওয়া যায়নি। যখন আপনার মাথাব্যথা হয়, তখন আপনার রক্তনালীতে বিদ্যমান সুনির্দিষ্ট কিছু স্নায়ু আপনার মস্তিষ্কে সংকেত পাঠায় যার কারণে সেখানে কিছু প্রদাহী পদার্থের আগমন ঘটে। স্নায়ুর এরকম আচরণের ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি।
কিছু কিছু কারণে মাইগ্রেন হঠাৎ করেই শুরু হয়ে যেতে পারে, যেমন: মানসিক চাপ, অভুক্ত থাকা, খাদ্য অবস্থিত সুনির্দিষ্ট কোন রাসায়নিক পদার্থ বা প্রিজারভেটিভস এর প্রতি সংবেদনশীলতা, ক্যাফেইন, ব্যাথানাশক ঔষধের দৈনন্দিন ব্যবহার, মেয়েদের হরমোনাল পরিবর্তন ইত্যাদি। এছাড়াও আলো, আবহাওয়ার পরিবর্তন, শারীরিক ক্লান্তি, কঠোর ডায়েট করা অথবা পর্যাপ্ত পানি পান না করা, সাধারণ ঘুমের প্যাটার্ন এ পরিবর্তন, উচ্চ শব্দ, ধোয়া, সুগন্ধি, রক্তনালী ফুলে যায় এসব মেডিকেশনের ব্যবহার প্রভৃতি নানা কারণে মাইগ্রেন হতে পারে।
টেনশন-টাইপ মাথাব্যথা
এই টাইপের মাথাব্যথায় মাথা, চেহারা এবং ঘাড়ের দিকে মৃদু থেকে মাঝারি তীব্রতার ব্যথা অনুভুত হয়। একে সংক্ষেপে টি টি এইচ ও বলা হয়। চার ধরণের টিটিএইচ আছে –
- ফ্রিকুয়েন্ট বা ঘন ঘন হয়,
- ইনফ্রিকুয়েন্ট বা কদাচিৎ,
- ক্রনিক বা তীব্র এবং
- সম্ভাব্য।
সাধারণত মহিলারা এই ধরণের মাথাব্যথায় বেশি ভুগে থাকেন। টেনশন টাইপ মাথাব্যথার জন্য সুনির্দিষ্ট কোন কারণ খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে ধারণা করা হয়, মাথার পিছনে বা ঘাড়ের পেশি শক্ত হয়ে গেলে এই ধরণের মাথাব্যথা হতে পারে। দীর্ঘসময় যান্ত্রিক স্ক্রিণে তাকিয়ে থাকাকালীন চোখের ক্লান্তি, টেমপোরোম্যান্ডিবুলার ডিজঅর্ডারের মতো সমস্যার কারণে ঘাড় এবং মাথার অন্যান্য অংশে ব্যথা, ইনসমনিয়া, পারিবারিক বা কর্মজীবনের স্ট্রেস প্রভৃতি কারণেও টেনশন-টাইপ মাথাব্যথা শুরু হতে পারে।
ট্রাইজেমিনাল অটোনোমিক সেফালএলজিয়া’জ বা সংক্ষেপে টিএসি
পাঁচ ধরণের টিএসি আছে।
- ১. ক্লাস্টার মাথাব্যথা
- ২. পারঅক্সিজমাল হেমিক্রেনিয়াজ
- ৩. স্বল্পস্থায়ী এক পার্শিক নিউরালজিফর্ম হেডএক এটাক অথবা ক্রেনিয়াল অটোনোমিক উপসর্গ
- ৪. হেমিক্রেনিয়া কন্টিনুয়া
- ৫. সম্ভাব্য টি এ সি
এদের মধ্যে ক্লাস্টার মাথাব্যথা সবচেয়ে বেশি হয়ে থাকে। এই মাথাব্যথা কেন হয়, তার সুনির্দিষ্ট কোন কারণ নেই তবে এই মাথাব্যথার সাথে মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাসের সংযোগ পাওয়া গেছে।
- * যারা ধূমপান করে, তাদের ক্লাস্টার মাথাব্যথা হবার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি
- * পারিবারিক ইতিহাস আছে, এমন ব্যক্তিদের এই ধরণের মাথাব্যথা হতে দেখা গেছে
- * মদ্যপান করলে হঠাৎ করেই এই মাথাব্যথা ট্রিগারড হতে পারে।
- * সুগন্ধি, পেইন্ট বা রং, পেট্রোলের তীব্র গন্ধে এই মাথাব্যথা হতে পারে।
প্রাথমিক মাথাব্যথা ডিজঅর্ডারের কারণ
- * দৌড়ানো, ভারউত্তোনল এর কারণে “ব্যায়ামের কারণে প্রাথমিক মাথাব্যথা” হতে পারে।
- * গ্রীষ্মকালে ঠান্ডা পানি, আইসক্রিম খাওয়ার কারণে ‘ঠান্ডা উদ্দীপক মাথাব্যথা’ হতে পারে।
- * কর্মক্ষেত্রে বা খেলাধুলা করার সময় হেলমেট বা গগলস পড়লে যদি মাথায় ক্রমাগত চাপ পড়ে, তাহলে ‘বাহ্যিক চাপের কারণে মাথাব্যথা’, ‘বাহ্যিক কমপ্রেশনের কারণে মাথাব্যথা’ হতে পারে।
- * ট্রাইজেমিনাল নার্ভের শেষপ্রান্তে ইরিটেশন এর কারণে ‘প্রাইমারি স্ট্যাবিং মাথাব্যথা’ হয়।
- * মস্তিষ্কের রক্তনালী ছিড়ে গেলে, স্ট্রোক, মস্তিষ্কে আঘাত, ভাসকুলাইটিস, এনসেফালাইটিস, মেনিনজাইটিস, রক্তচাপ হঠাৎ বেড়ে গেলে, দেরীতে গর্ভধারণ, মস্তিষ্কের রক্তনালীতে স্পাজম – – ভ্যাসোকনস্ট্রিকশন সিনড্রোম প্রভৃতি নানা কারণে ‘প্রাথমিক থান্ডারক্ল্যাপ মাথাব্যথা’ হতে পারে।
- * সংক্রমণ, ব্রেইন টিউমার বা মস্তিষ্কের আঘাতজনিত কারণে এনডিপিএইচ বা ‘প্রাত্যহিক ক্রমাগত মাথাব্যথা’ হতে পারে।
- * হিপনিক টাইপের মাথাব্যথা বিরল ধরণের। আপনি যখন ঘুমিয়ে আছেন, সে অবস্থায় এ মাথাব্যথা হাজির হয়ে আপনাকে জাগিয়ে দিবে। একে “এলার্ম ঘড়ি” মাথাব্যথা হিসেবেও উল্লেখ করা হয়ে থাকে কারণ এই ধরণের মাথাব্যথা সপ্তাহের কয়েক রাতে একই সময়ে হয়ে থাকে। অনেকে প্রায় প্রতি রাতেই এই মাথাব্যথায় ভুগে থাকেন। স্লিপ ফাউন্ডেশন এর মতে, মেলাটোনিন উৎপাদন হিপনিক মাথাব্যথার সাথে সম্পর্কিত। মেলাটোনিন হরমোনের কারণেই আমাদের ঘুম আসে। যেহেতু হিপনিক মাথাব্যথা প্রতি রাতে একই সময়ে হয়ে থাকে, তাই কিছু গবেষক বিশ্বাস করেন যে মেলাটোনিন উৎপাদন এর কার্যক্রমে কিছু ব্যাঘাত সৃষ্টির কারণেই হয়তোবা মেলাটোনিন লেভেল কমে গিয়ে হিপনিক মাথাব্যথার সৃষ্টি করে।
সেকেন্ডারি মাথাব্যথার কারণ
সেকেন্ডারি মাথাব্যথা অন্য কোন রোগ বা ডিজঅর্ডারের কারণে হয়ে থাকে। মাইগ্রেন, টেনশন-টাইপ মাথাব্যথা অথবা ক্লাস্টার মাথাব্যথার মতো প্রাথমিক মাথাব্যথা থেকে সেকেন্ডারি মাথাব্যথাকে আলাদা করতেই এই প্রকারের আবির্ভাব।
অনেক রোগের উপসর্গ হিসেবে সেকেন্ডারি মাথাব্যথা হয়ে থাকে, যা মস্তিষ্কের ব্যথা-সংবেদনশীল স্নায়ুকে সক্রিয় করে।
সেকেন্ডারি মাথাব্যথা হবার সম্ভাব্য কারণগুলো হচ্ছে:
- একিউট সাইনুসাইটিস ( ন্যাসাল এবং সাইনাসে সংক্রমণ)
- আর্টারি ছিড়ে যাওয়া
- ভেনাস থ্রম্বোসিস: মস্তিষ্কের মধ্যে রক্ত জমাট বাধা
- ব্রেইন এনইউরিজয়ম: মস্তিষ্কের রক্তনালীতে স্ফীতি বা বেলুন আকৃতি তৈরী হওয়া
- ব্রেইন আর্টেরিওভেনাস ম্যালফরমেশন: মস্তিষ্কের রক্তনালীতে জট বেধে যাওয়া
- ব্রেইন টিউমার: একাউস্টিক নিউরোমা, এসট্রোসাইটোমা, কোরোয়েড প্লেক্সাস কারসিনোমা, ক্রেনিওফ্যারিঞ্জিওমা, এপেনডাইমোমা, গ্লিওব্লাসটোমা, গ্লিওমা, মেডুলোব্লাস্টোমা, মেনিনজিওমা, অলিগোডেনড্রোগ্লিওমা, পিনিওব্লাস্টোমা, পিটুইটারি টিউমার ইত্যাদি
- কার্বন মনো অক্সাইড বিষক্রিয়া
- মাথার খুলির গোড়া বা বেস এ গাঠামোগত সমস্যা: কিয়ারি ম্যালফরমেশন
- কোভিড-১৯ পজিটিভ
- পানিস্বল্পতা
- দাঁতের সমস্যা
- মধ্যকর্ণে সংক্রমণ
- এনসেফালাইটিস: মস্তিষ্কের প্রদাহ
- মেনিনজাইটিস
- জায়ান্ট সেল আর্টেরাইটিস
- উচ্চরক্তচাপ
- ইনফ্লুয়েঞ্জা
- ইন্ট্রাক্রেনিয়াল হেমাটোমা
- ব্যথার ঔষুধ এর মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার
- প্যানিক এটাক/ প্যানিক ডিজঅর্ডার
- স্ট্রোক
- টক্সোপ্লাজমোসিস
- ট্রাইজেমিনাল নিউরালজিয়া ইত্যাদি।
টেনশন টাইপ মাথাব্যথা (টি টি এইচ) সহ অন্যান্য নানা ধরণের মাথাব্যথা দূর করতে ফিজিওথেরাপি একটি গবেষণাভিত্তিক চিকিৎসাপদ্ধতি।
সারভাইক্যাল ব্যায়াম, রিলাক্সেশন, ম্যাসাজ, পশ্চারাল ব্যায়াম, ক্রেনিও-সাইভাইকাল টেকনিক, থার্মোথেরাপি, ভার্টিব্রাল মোবিলাইজেশন এবং স্ট্রেচিং টিটিএইচ এর উপসর্গ যেমন ব্যথার তীব্রতা এবং পুনরাবৃত্তির হার কমাতে কার্যকরী। একই সাথে জীবনমান অ মানসিক দিকের উন্নয়ন এবং ব্যথা সম্পর্কিত প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণেও ভুমিকা রাখে।
No comments